ট্রাম্প প্রশাসনের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ প্ল্যান বা বিপরীত শুল্ক পুরো বিশ্বের ভূ-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগী দেশ যেমন : চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ভারতও এই শুল্কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে
রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প বাজার এবং রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে বাংলাদেশের নজর দেওয়া জরুরি। কেননা বাণিজ্যযুদ্ধের অংশ হিসাবে চীনের পণ্যে সবচেয়ে বেশি শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাজার ধরে রাখতে চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নে কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারে। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশ কষ্টসাধ্য হবে। পূর্ব এশিয়া বাংলাদেশের জন্য রপ্তানির বড় বাজার হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে।
মঙ্গলবার রাজধানীতে ‘শুল্ক কারসাজির যুগে বাণিজ্যনীতি, বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন।
বনানীর নিজস্ব কার্যালয়ে এক সেমিনারের আয়োজন করে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। পিআরআই-এর চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারমান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রেহমান সোবহান বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাণিজ্যের বিষয়টিকে এখন অস্ত্রে রূপান্তরিত করেছে। সুইফট সিস্টেম, ডলার এবং সর্বশেষ ট্যারিফ প্ল্যান। এ ধরনের শুল্কারোপ অন্যায্য এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতির প্রতি অবহেলা। তবে শেষ পর্যন্ত এ শুল্ক কাঠামো টেকসই হবে না। ট্রাম্প যেভাবে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলার চেষ্টা করছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল ঘটনা। এমন ঘটনা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর মধ্য দিয়ে বাজার অর্থনীতি ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প যেভাবে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চাচ্ছেন, সেভাবে ঘাটতি কমানো সম্ভব নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রই এ পদক্ষেপ থেকে কোনো সুফল পাবে না বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে উচ্চ শুল্কের খড়্গ থেকে বাঁচতে রপ্তানি বৃদ্ধির কথা বলেছে, তা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানি করা হয় বিনা শুল্কে। সেই সুতা দিয়ে তৈরি পোশাক বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। আমরা কি চাইলেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানি বাড়াতে পারব? আমরা বিভিন্ন ধরন, দাম ও বাজারের জন্য পোশাক উৎপাদন করি। ফলে সব পোশাক মার্কিন সুতা দিয়ে তৈরি করা যাবে না; কমান্ড ইকোনমির মতো হুকুম দিয়ে তো এই আমদানি বাড়ানো সম্ভব নয়।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান, রিসার্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রিশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক, সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার উল আলম পারভেজ, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ।
অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, আকস্মিকভাবে ট্রাম্প প্রশাসন ট্যারিফ প্ল্যান আরোপ করেনি। ইউএসএআইডির সহায়তা বন্ধ ও ট্যারিফ প্ল্যান আরোপ একই সূত্রে গাঁথা। আমরা হয়তো নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পদার্পণ করতে যাচ্ছি। আগামী দিনে এ ধরনের আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ আসতে পারে। ট্যারিফ প্ল্যানের প্রভাব থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের ট্যারিফ পলিসির সংস্কার প্রয়োজন আছে। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়। এর সঙ্গে অন্য নীতিগত ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প ডব্লিউটিওকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সংস্থাটির আপিল কার্যক্রম অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। ফলে ট্যারিফ প্ল্যানের বিরুদ্ধে ডব্লিউটিওতে চীন ও কানাডা যে আপিল করেছে, এর কিছুই হবে না।
ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দোহা রাউন্ডের পর ডব্লিউটিও’র দাত ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন উন্নত বিশ্ব জি-২০ দেশগুলো যেভাবে ট্যারিফ বসাচ্ছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র যে ফর্মুলায় ট্যারিফ আরোপ করেছে, এর ভিত্তি নেই। পৃথিবীর ওপর গড়ে ২২ শতাংশ ট্যারিফ বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে দেশটিতে পোশাকের দাম ১০ শতাংশ বাড়বে এবং ভোগ ৩২ শতাংশ কমবে। বাজার সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনকে শায়েস্তা করতে দেশটির পণ্যে সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগী সক্ষমতা কমায় চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে নজর দেবে এবং সস্তায় এ অঞ্চলে পোশাক সরবরাহ করবে। তখন বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের অসুবিধায় পড়তে হবে। কারণ, মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশের বেশি ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
আনোয়ার উল আলম পারভেজ বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগাগোড়াই যা বলে, তার পরবর্তীরা সেটি অনুসরণ করে। তার নতুন ট্যারিফ প্ল্যান ক্ষণস্থায়ী হবে নাকি দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া তখন থেকেই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য জোরদারে কাজ করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে কম্বোডিয়ার ৪টি এবং পাকিস্তানের ২৬টি লবিস্ট ফার্ম সে দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা থাকায় তিনি নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
শামস মাহমুদ বলেন, দুই মাস আগে ট্যারিফ প্ল্যানের বিষয়ে জানুয়ারিতে ট্রাম্প ধারণা দিলেও বাংলাদেশ তা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়নি। কোন কোন পণ্যের শুল্ক বাংলাদেশ কমাবে, সে বিষয়ে তাদের জানানো হয়নি। এখনো বিষয়গুলো নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে, যা আমাদের রপ্তানির জন্য সুখকর নয়। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যেসব পণ্যের মূল্য সংযোজন বেশি, সেসব উচ্চমূল্যের সিনথেটিক বা ম্যান মেইড ফাইবারের ফেব্রিক্সের পোশাকের শুল্ক ৭৮ শতাংশের বেশি আরোপ করা হয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে এটি বড় ধাক্কা।